আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করার আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রার্থীদের অভিযোগ, নির্বাচনের মিছিল-মিটিং কিংবা স্বার্থান্বেষী মহল সহিংসতা ঘটাতে প্রলোভনে ফেলে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করতে পারে। তবে এরইমধ্যে সব প্রার্থীকে নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়েছে পুলিশ। পাশাপাশি সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এপিবিএন।
কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের উখিয়ার কুতুপালং টিভি টাওয়ার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সড়কের পাশেই রয়েছে রোহিঙ্গাদের শত শত বসতি। আর রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে যেতে না পারে সে জন্য দেয়া হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া। কিন্তু সেই কাঁটাতারের বেড়া কেটে করা হয়েছে ফাঁকফোকর। যা দিয়ে অবাধে ক্যাম্প ছাড়ছে অনেক রোহিঙ্গা, টাকা কামাইয়ের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে নানা পেশায়।
রোহিঙ্গারা বলছেন, কাঁটাতারের ফাঁকফোকর বা চেকপোস্ট ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্প ছাড়ছেন তারা। লক্ষ্য, যে কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জন।
ক্যাম্প-৭ এর বাসিন্দা ইদ্রিস আলী বলেন, ‘আমি কাজের সন্ধানে কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে এসেছি।’
একই ক্যাম্পের বাসিন্দা ইজিবাইকচালক আবদুর রহিম বলেন, ‘ক্যাম্প ছেড়ে বের হয়ে ইজিবাইক চালাচ্ছি। সকালে ক্যাম্প থেকে বের হয়ে সন্ধ্যায় আবার ক্যাম্পে ফিরে যাই। কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে বের হই। আবার মাঝেমধ্যে চেকপোস্ট দিয়েও বের হই।’
ক্যাম্প-২ এর বাসিন্দা ফিরোজ বলেন, ‘ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার জন্য কাঁটাতারের বেড়া কেটে যে পথ তৈরি করা হয়েছে, সেই পথ দিয়ে প্রতিদিনই বের হচ্ছি। দিনমজুরের কাজ পেলে ওই কাজ করছি, না পেলে অন্য কাজ করছি। এভাবে চলছি।’
আরেক রোহিঙ্গা সেলিম উল্লাহ বলেন, ‘ক্যাম্প ছেড়ে বের হয়েছি পেটের দায়ে। ক্যাম্প যা দিচ্ছে তা দিয়ে সংসার চলছে না। তাই ক্যাম্প ছেড়ে বের হয়ে যে কাজ পাচ্ছি তা করে টাকা উপার্জন করছি। কোথাও নিরাপত্তা নেই; ক্যাম্পেও নেই, আবার নিজ দেশেও নেই।’
এদিকে নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের অভিযোগ অনেক পুরানো। ভোটের মিছিল-মিটিং, প্রচার-প্রচারণা, পোস্টার লাগানোসহ নানা কাজে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হয়। তাই এবারও বেড়েছে সেই শঙ্কা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রার্থীদের দাবি, নির্বাচনে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল সহিংসতা ঘটাতে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করতে পারে।
কুতুপালং ক্যাম্পসংলগ্ন রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘পূর্ব অভিজ্ঞতা বলছে, নির্বাচন ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনেও রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। এই কাজে না জড়ানোর জন্য আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রচেষ্টা ও প্রচারণা অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসনের হস্তক্ষেপও জরুরি।’
কক্সবাজার-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. নুরুল বশর বলেন, ‘মানবতার কারণে রোহিঙ্গাদেরকে উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কৌশলে অনেক রোহিঙ্গাকে ব্যবহার করে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করবে স্বার্থান্বেষী মহল।’
র্যাব ১৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা এ আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারি না। যে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল রোহিঙ্গাদেরকে নির্বাচনকেন্দ্রিক যেকোনো কাজে ব্যবহার করতে পারে। ফলে আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।’
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর প্রবেশদ্বারে রয়েছে এপিবিএনের চেকপোস্ট। কিন্তু এসব চেকপোস্টেও দেখা যায় ঢিলেঢালা ভাব। তবে নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার না করতে সব প্রার্থীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে কক্সবাজার জেলা পুলিশ। আর সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এপিবিএন।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। কারণ কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা রয়েছে। এই রোহিঙ্গারা যাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনো প্রক্রিয়ায় জড়িত হতে না পারে এই জন্য কক্সবাজারের সব প্রার্থীর কাছে সহযোগিতা চাই।’
উখিয়া ৮ এপিবিএনের সহঅধিনায়ক (পুলিশ সুপার) খন্দকার ফজলে রাব্বী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় এপিবিএনসহ সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়িত্ব পালন করছে। ক্যাম্পের ভেতরে-বাইরের তল্লাশি চৌকি বাড়ানো হয়েছে। নির্বাচনের দিন কঠোর অবস্থানে থাকবে প্রশাসন। যেন আশ্রিত রোহিঙ্গারা ক্যাম্পেই অবস্থান করে। এপিবিএন সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।’
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘নির্বাচনের সময় রোহিঙ্গা যুবকেরা যেন ক্যাম্পের বাহিরে না যায়, সেজন্য ৩৩টি জমকালো ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হবে। নির্বাচনের দিন ভলিবল খেলার ব্যবস্থাও থাকবে। এক মাস আগে থেকেই নজরদারির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কোনভাবেই যেন রোহিঙ্গাদের এই কাজে জড়ানো না হয় সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হচ্ছে।’
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয় শিবিরে বসবাস করছে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা।
পাঠকের মতামত